গ্রামের বৈচিত্র্যময় জীবন যাপনের গল্প শুনে শুনে শহরে বড় হয়েছে ছেলেটি। বাবা মায়ের চাকরির সুবাদে গ্রামের মুখ আর তার দেখা হয়ে উঠে নাই। বাবা মায়ের সাথে শহরে বড় হয়েছে বলে, মাঝে মাঝে মাকে জিজ্ঞাসা করে, ধান গাছে কি কাঠ হয়, গমের গাছ দেখতে কেমন? আলু যদি মাটির নিচে ধরে তাহলে লেবুও কী মাটির নিচে উৎপাদন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি কত যে বৈচিত্র্যময় কৌতূহলী প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়াতে হয়েছে ছেলেটির মায়ের। অবশেষে ছেলেটির বয়স যখন সতেরো তখন ছেলেটি শপথ নিলেন আমি বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রাম বাংলার বৈচিত্র্যময় দৃশ্য নিজের চোখে অবলোকন করবো। যেই শপথ সেই কাজ। টিফিনের গোছানো টাকা দিয়ে কিনে নিলেন একটা অল্প দামি মোটরবাইক। টেনশন। এখন মোটরবাইকের তেল খরচ কোথায় থেকে যোগাড় করবে। কোন একজনের বুদ্ধি শুনে তৈরি করলো সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম । মোটরবাইক নিয়ে ঘোরার সময় তৈরি হত ভিডিও। সেই ভিডিও প্রকাশ করে তার সামাজিক প্লাটফর্মে । সেখান থেকে যে আয় করে তা দিয়েই চলছে তার ঘোরাঘুরি। বর্তমানে তার এই সকল ভিডিও থেকে এত পরিমানে আয় হয়; যা কোন চাকরিজীবী তার আয়ের ধারের কাছেও নেই।
এমনি একদিন গুগল ম্যাপের সাহায্য চলে এলেন প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। নাম ঢালারচোর। আষাঢ় মাসে চারিদিকে পানি। পৌষ মাঘ ফাল্গুন মাসে মাঠকে মাঠ নানা ফসলের সমারোহ । কিন্তু চৈত্র মাসে এসে আবার মাঠ ফাঁকা। বৃষ্টি না পড়া অবধি এমনি রিক্ত থাকবে এই মাঠ। পথ ঘাট বলতে তেমন কিছু নেই। শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের আইল হল সাধারণ মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তা। আর বর্ষার মৌসুম চলে নৌকা।
কাশীনাথপুর থেকে রওনা দিয়ে মাঠ পেরিয়ে গ্রামে উঠতে উঠতে বেলা দুপুর হয়ে এলো। চৈত্র মাস । দুপুর যেন দুপুর নয়। এ যেন আগুনের দাপদাহ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মহিলার কাছ থেকে পানি চাইতেই; মহিলা দু’জন ঘোমটা তুলে কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তার হদিস জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কেউ জানে না। একটা গাছের নিচে মোটরবাইক স্ট্যান্ড করে শীতল ছায়াময় গাছের নিচ দিয়ে শ্রীকান্তের মত উদাস মনে হাঁটতে লাগলো ছেলেটি। শীতল শ্রীগন্ধ দক্ষিণা বাতাসে শরীর যেন স্বর্গ খুঁজে পেল। হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে ভেসে আসলো একটা টিউবওয়েল। এ যেন বালু চরে স্বর্ণ খুঁজে পাওয়া মত। টিউবওয়েল থেকে পানি পান করার শেষে, কানে ভেসে আসলো কোরআন তেলওয়াতের শব্দ। হাতের ডানে তাকিয়ে দেখলো একটা মসজিদ। মসজিদের মুছুল্লিদের ওযুর পানি সরবরাহ করে এই টিউবওয়েল। পানি পানের শেষে নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হলো তার। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মোটরবাইকের দিকে ছেলেটি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মোটরবাইকের দিকে চোখ পড়তেই, চোখ তো চড়ক গাছে উঠে গেলো। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে মোটরবাইকের উপর এমন হুরমুর করে পড়েছে; দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন বর্ষার মৌসমে বৃষ্টির পানির স্রৌতে উঠে আসা কই, পুঁটি, টাকি মাছ ধরছে। দৌড়ে এসে এক ধমকে ছেলে মেয়েদের তাড়িয়ে দিলো। এগারো থেকে বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে একটু বেশি ভুল করে বসলো । মেয়েটি মোটরবাইকের লুকিং গ্লাস খুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন ছেলেটি জোরের সাথে ধমক দিয়ে লুকিং গ্লাস কেড়ে নিলো।
এ দিকে মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গিয়ে বললো একটি ছেলে তাঁকে মেরেছে। এটা একটা মহা মিথ্যা কথা। গ্রামের ছেলে মেয়ে ঠিক এমনি হয়। নিজের অপবাদ ঢাকতে গিয়ে অন্যকে অপরাধী বানায়। মেয়েটি তার পা দেখিয়ে বললো এইখানে ছেলেটি মেরেছে। অথচ এই মেয়েটি পা-খানা মোটরবাইকের সাইলেনসারের লেগে পুড়ে গেছে। এভাবে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ছোট ছোট মিথ্যা হাঙ্গামা থেকে দাঙ্গামা, এমনকি খুন খারাপি দিকে নিয়ে যায়।
কোন কথা নেই। ঐ মেয়ের ভাই বাড়ি থেকে একটি বাঁশ নিয়ে ছুটে এসে বাইকওয়ালা ছেলেটির গারের উপর বাঁশ দিয়ে একটি আঘাত করলো। আঘাত খেয়ে ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মাঠিতে পড়ে গেলো। মাথায় থাকা হেলমেটটি ছুটে গিয়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির নাক দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। আঘাত দেওয়া ছেলেটি রক্ত দেখে ভয়ে পালিয়ে গেলো। তারপরে চোখের পলক নিভিয়ে আসলো ছেলেটির।
দুপুর গড়তে না গড়তেই, মসজিদের ইমাম সাহেব আবিষ্কার করলো ছেলেটি মারা গেছে। কোথাকার এই ছেলে? কী তার নাম ? হিন্দু নাকি মুসলিম? কে জানে !
অবশেষে ইমাম সাহের মৃত্যু ছেলেটির শিশ্ন দেখে আবিষ্কার করলো ছেলেটি মুসলিম । কেননা ছেলেটির সুন্নতে খাৎনা দেওয়া। অবশেষে গ্রামের মানুষের চাঁদা ছেলেটিকে মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন কাঁপন করা হলো। পাঁচ দিনের মাথায় মুসলিম রীতি অনুযায়ী কোরান খতম দিয়ে ছেলেটির জন্য খয়রাত (কুলখানি) সম্পূর্ণ করা হলো।
এগারো দিনের মাথায় গ্রামে দুই গাড়ি অপরিচিত মানুষের প্রবেশ ঘটলো। সাথে পুলিশ। তাদের সামনে যেতে কারো সাহস হচ্ছিল না। অবশেষে পরহেজগার ইমাম তাদের সামনে আসলেন।
– আপনি ইমাম সাহেব?
– জী,
একটা ছবি বের করে এস.আই তরিকুল, ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো, দেখুন তো ইমাম সাহেব, এই বিচারাকে চিনেন কী না?
– জী, এটা তো আমার ছবি?
অন্য একটা ছবি বের করে আবার জিজ্ঞাসা করলে, দেখুন তো এই ব্যক্তিকে চিনতে পারেন কী না?
জী, চিনি। কয়েক দিন আগে এই ছেলে আমাদের গ্রামে এসেছিল । ছেলেটির গারে সম্ভব তো জ্বিন ছিলো। দুপুর বেলা একা একা পেয়ে ঐ আম গাছের নিচে জ্বিন তাকে মেরে রেখে গিয়ে ছিল। ছেলেটি একটা মোটরগাড়ি নিয়ে আসছিল। মোটর গাড়িটি এখন আমাদের মসজিদের বারান্দায় রাখা আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিছি আগামী সপ্তাহে আমরা মোটরবাইকটি বিক্রয় করে মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজে লাগিয়ে দিবো। এহাতে ছেলেটির কবরে অনেক ছুয়াব নাজিল হবে। ছেলেটি জান্নাতে যাবে, ইনশাল্লাহ। আমিন।
এবার দেখুন তো এই ছেলেটিকে চিনেন কী না?
জী, চিনি। বড় সতজন ইব্রাহিম খাঁর ছোট ছেলে । আলামিন খাঁ। বড় সতজন ছেলেটি। খাচ্চা ইমানদার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।
খুব ইমানদার ? না ? আলামিন খাঁকে ঢেকে আনেন।
হঠাৎ করে গ্রামের কোন একজন বলে উঠলো, ঐ যে আলামিন বিলের দিকে যাচ্ছে দৌড়াতে দৌড়াতে ।
এস আই তরিকুল সঙ্গে সঙ্গে কনেস্টবলদের আদেশ করলো ধরো ঐ খুনীকে। পাঁচ জন কনেস্টবল দৌড়াতে শুধু করে দিল আলামিন খাঁর পিছে পিছে। দৌড়ানোর দুই মিনিট পরে একটা গুলির শব্দ শুনো গেলে। আলামিন খাঁ মাঠের মধ্যে মাটিতে লুটে পড়লো । পুলিশের কনেস্টবলগুলো গিয়ে তার শরীরে উপরে ওপর হয়ে পড়লো ।
এস আই তরিকুল বললো, যাক প্রধান আসামি ধরা পড়েছে। দ্বিতীয় আসামি ইমাম সাহেবের হাতে হাতকরা পড়াও।
ইমাম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলে। এত সময় তিনি আল্লাহ্ নামে যিকির করছিল। এখন আল্লার নাম রেখে এস আই তরিকুলের পা জড়িয়ে ধরে । তরিকুলের নামে যিকির করতে শুরু করে দিলো।
একে একে গ্রামের প্রধানগণ সহ ইউপি মেম্বারকে আটক করা হলো।
সব খবর খুব দ্রুত ইউপি চেয়ারম্যানের কানে চলে গেলো। চেয়ারম্যান চলে আসলেন সমস্যার সমাধান দিতে। এস আই তরিকুলকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এদের ধরে নিয়ে যাওয়া কারণ কী? তরিকুল সাহেব বললেন, আলামিন খাঁর শুফম হাওলাদার নামের একটি ছেলেকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে । সেই হত্যার সাহায্য করেছে, এই ইমাম সাহেব । আর ছেলেটি ছিল হিন্দু, কিন্তু তার ধর্মকে অবমাননা করে মুসলিম রীতি অনুযায়ী সৎকার্য সম্পূর্ণ করেছে এই প্রধানগণ। একজন মানুষ হত্যা, ধর্ম অবমাননা, তথ্য গোপন করার দায়ে আসামি করে তাদেরকে আটক করা হয়েছে।
এস আই সাহেব আপনি, যা বললেন তার সত্যতা কী? চেয়ারম্যান জিজ্ঞাসা করলেন ।
এস আই তরিকুল, একটি ভিডিও দেখালেন এবং বললেন, এই ছেলে যখন এই গ্রামে প্রবেশ করে তখন তার এই ভ্রমনটি ফেসবুক লাইভ হচ্ছিল। এখানে যা যা ঘটেছে সব ফেসবুক ও নেটে আছে। সেই তথ্যের সূত্র ধরে আমাদের এখানে আসা এবং আসামিদের গ্রেফতার করা।
এতখন পরে ইমাম সাহেব মুখ খুললেন। ছেলেটি যদি হিন্দুই হবে তাহলে তার সুন্নতে খাৎনা দেওয়া ছিল কেন?
ছেলেটির একজন আত্মীয় বললেন, ছোট বয়সে শুফমের শিশ্ন দিয়ে পুঁজ পড়তো, তাই ডাক্তার সেই রোগ প্রতিরোধ করতে ওর শিশ্নের উপরের অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলে দেয় । এটা সুন্নতে খাৎনা ছিল না ।
ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে ছেলেটির লাশ তোলা হয়ে গেলো । সন্ধ্যা নেমে এলো। মসজিদ থেকে ভাঙা ভাঙা ছোট কণ্ঠে আযানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগলো। পুরুষ শূন্য গ্রামটি সন্ধ্যার পরে যেন মাঝ রাত মনে হতে লাগলো গ্রামের সকল মেয়েদের কাছে। মাঝে মাঝে এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে হালকা কিংবা ভারি কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগলো । আল্লাহ্ ভালো যানে কার কার যে মৃত্যুদণ্ড হবে !
———————————————————–
শাবলু শাহাবউদ্দিন
কবি ও গল্পকার
ঠিকানা
গ্রাম: সাদুল্লাপুর
ডাকঘর: দুবলিয়া
উপজেলা: পাবনা সদর
জেলা: পাবনা
দেশ: বাংলাদেশ
+8801746631125
স্টিং নিউজ সার্ভিস: নদিয়ার ধুবুলিয়ার পন্ডিতপুর গ্রামে দাদুর স্মৃতিতে স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির করলেন নাতি। আর এমন যোগ্য নাতির প্রংশাংয় পঞ্চমুখ…
স্টিং নিউজ সার্ভিস: নদিয়ার ধুবুলিয়ার সাথী ক্লাবের কালীপুজোর বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের মতো এক মানবিক উদ্যোগে অংশ নিলেন জনপ্রিয় ইউটিউবার কিরণ…
স্টিং নিউজ সার্ভিস: নদিয়ার কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অন্তর্গত থানারপাড়া থানার উদ্যোগে বুধবার ‘উৎসর্গ’ প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত হলো রক্তদান শিবির ও…
স্টিং নিউজ সার্ভিস: শুক্রবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগর বিসর্জন ঘাটে সমাপ্ত হল চার দিনের নদী সচেতনতা কায়াক অভিযান। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাধা সত্ত্বেও,…
সমিরণ বিশ্বাস, স্টিং নিউজ করেসপনডেন্ট, তেহট্ট: নদী রক্ষা এবং জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজ শুরু হলো এক…
স্টিং নিউজ সার্ভিস: ওবিসি (অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি) সংরক্ষণ বাতিলের কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা…